মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা:) এর প্রিয় ফল জলপাই

যায়তুন ফলের উপকারিতাঃ


 মহানবী (সাঃ)-এর পছন্দের ফলগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলো জয়তুন (জলপাই)। জয়তুন (জলপাই) এর  তেল শরীরের জন্য বেশ উপকারী। রাসুল (সাঃ) নিজে শরীর মুবারকে  ব্যবহার করতেন এবং সাহাবায়ে কেরামকেও জয়তুনের (জলপাই) তেল ব্যবহারের তাগিদ দিতেন। হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) বলেন, রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা (জয়তুনের) তেল খাও এবং তা শরীরে মালিশ করো। কেননা এটি বরকত ও প্রাচুর্যময় গাছের তেল। (তিরমিজি, হাদিস : ১৮৫১)

কোরআনে বর্ণিত ফলগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি ফল  জয়তুন বা  জলপাই।  সুরা ত্বিনের প্রথম আয়াতে মহান আল্লাহ যে ফলের কস’ম খেয়েছেন।আল্লাহ তা য়ালা বলেন,,وَ التِّیۡنِ وَ الزَّیۡتُوۡنِ ۙ﴿۱﴾

শপথ তীন ও যাইতূনের। [১] [১] ('তীন' ডুমুরজাতীয় এক প্রকার মিষ্টি ফল; যার গাছ ও ফল ডুমুর গাছ ও ফলের মতই দেখতে। উর্দুতে 'আনজীর' তর্জমা দেখে তা আমাদের দেশের 'পেয়ারা' 'আঞ্জীর' বা 'আমসপেরা' মনে করা ভুল। যয়তূনকে ইংরেজীতে 'অলিভ' বলা হয়। বাংলাতে এর অনুবাদ 'জলপাই' করা হয়ে থাকে।) 

এই ফলের গাছকে আখ্যা দিয়েছেন মুবারক গাছ হিসেবে। ইরশাদ হয়েছে, 

اَللّٰہُ  نُوۡرُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ مَثَلُ نُوۡرِہٖ کَمِشۡکٰوۃٍ  فِیۡہَا مِصۡبَاحٌ ؕ اَلۡمِصۡبَاحُ فِیۡ زُجَاجَۃٍ ؕ اَلزُّجَاجَۃُ کَاَنَّہَا کَوۡکَبٌ دُرِّیٌّ یُّوۡقَدُ مِنۡ شَجَرَۃٍ مُّبٰرَکَۃٍ  زَیۡتُوۡنَۃٍ  لَّا شَرۡقِیَّۃٍ  وَّ لَا غَرۡبِیَّۃٍ ۙ یَّکَادُ زَیۡتُہَا یُضِیۡٓءُ وَ لَوۡ لَمۡ تَمۡسَسۡہُ نَارٌ ؕ نُوۡرٌ عَلٰی نُوۡرٍ ؕ یَہۡدِی اللّٰہُ  لِنُوۡرِہٖ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ یَضۡرِبُ اللّٰہُ الۡاَمۡثَالَ لِلنَّاسِ ؕ وَ اللّٰہُ  بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ ﴿ۙ۳۵﴾

আল্লাহ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর জ্যোতি;[১] তাঁর জ্যোতির উপমা যেন সে তাকের মত; যার মধ্যে আছে এক প্রদীপ, প্রদীপটি একটি কাঁচের আবরণের মধ্যে স্থাপিত, কাঁচের আবরণটি উজ্জ্বল নক্ষত্র সদৃশ; যা পবিত্র যয়তুন বৃক্ষের তৈল হতে প্রজ্জ্বলিত হয়, যা প্রাচ্যের নয়, প্রতীচ্যেরও নয়, অগ্নি স্পর্শ না করলেও মনে হয় ওর তৈল যেন উজ্জ্বল আলো দিচ্ছে; জ্যোতির উপর জ্যোতি![২] আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাঁর জ্যোতির দিকে পথনির্দেশ করেন।[৩] আল্লাহ মানুষের জন্য উপমা দিয়ে থাকেন।[৪] আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ। [১] অর্থাৎ, যদি আল্লাহর অস্তিত্ব না থাকত, তাহলে না পৃথিবীতে আলো থাকত, না আকাশে। আর না পৃথিবী ও আকাশের কেউ সুপথপ্রাপ্ত হত। অতএব আল্লাহ তাআলাই আকাশ ও পৃথিবীকে আলোদানকারী। তাঁর গ্রন্থও আলো। তাঁর রসূলও (গুণগত দিক দিয়ে) আলো। যেমন বাল্ব ও প্রদীপ হতে মানুষ আলো পায়, তেমনি উক্ত দুই আলো দ্বারা মানুষ জীবন পথের অন্ধকার দূর করে সঠিক পথে চলতে পারে। হাদীসেও আল্লাহর নূর (জ্যোতি বা আলো) হওয়ার কথা প্রমাণিত আছে। যেমন তাহাজ্জুদের নামাযে দাঁড়িয়ে সানার দু'আতে মহানবী (সাঃ) বলতেন, اَللّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ نُوْرُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَ مَنْ فِيْهِنَّ অর্থাৎ, হে আল্লাহ! তোমারই যাবতীয় প্রশংসা। তুমি আকাশমন্ডলী, পৃথিবী এবং উভয়ের মধ্যে অবস্থিত সকল কিছুর জ্যোতি। (বুখারীঃ রাত্রের তাহাজ্জুদ পরিচ্ছেদ, মুসলিমঃ মুসাফিরের নামায অধ্যায়) অতএব আল্লাহর সত্তা নূর, তাঁর পর্দা নূর, আসল ও রূপক অর্থের প্রত্যেক নূরের তিনিই স্রষ্টা। নূর প্রদানকারী এবং তার প্রতি পথ প্রদর্শনকারীও একমাত্র তিনিই। (আইসারুত্ তাফাসীর) [২] অর্থাৎ, যেমন একটি তাকে একটি প্রদীপ রাখা আছে এবং তা আছে একটি কাঁচের আবরণের ভিতর। আর ওর মধ্যে এমন বরকতময় গাছের এক বিশেষ ধরনের তেল ভরা হয়েছে; যা বিনা দিয়াশলাই-এ নিজে নিজেই আলোকিত হওয়ার উপক্রম। এইভাবে সমস্ত আলো একটি তাকে জমা হয়েছে এবং তা আলোয় আলোময় হয়ে রয়েছে। অনুরূপ আল্লাহর অবতীর্ণকৃত দলীল প্রমাণের অবস্থা, যা অতি স্পষ্ট এবং একটি অন্যের তুলনায় আরো উত্তম। যা আলোর উপর আলো। যা 'যা প্রাচ্যের নয়, প্রতীচ্যেরও নয়' অর্থাৎ, পূর্বের নয়, পশ্চিমেরও নয় --এর অর্থ হল, সে গাছ এমন এক খোলা ময়দান ও বৃক্ষহীন প্রান্তরে বিদ্যমান, যার উপর সূর্যের আলো শুধু ওঠার অথবা ডোবার সময়েই পড়ে না; বরং সারা দিন পড়ে। আর এ রকম গাছের ফল পুষ্ট ও ভালো হয়। সে গাছ হল, যায়তুন গাছ। যার ফল ও তেল তরকারী (আচার) হিসাবে এবং প্রদীপের তেল হিসাবেও ব্যবহার হয়ে থাকে। [৩] এখানে 'তাঁর জ্যোতি' বলতে ইসলাম ও ঈমানকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, যার মধ্যে মহান আল্লাহ ঈমানের প্রতি আগ্রহ ও অনুসন্ধিৎসা দেখেন, তাকে ঐ জ্যোতির প্রতি দিক নির্দেশনা করেন। যার ফলে দ্বীন-দুনিয়ার কল্যাণের দরজাসমূহ তার জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। [৪] যেমন মহান আল্লাহ এই উদাহরণ বর্ণনা করেছেন, যার মধ্যে তিনি ঈমানকে, তা নিজ মু'মিন বান্দাদের অন্তরে সুদৃঢ় হওয়াকে এবং বান্দাদের অন্তরের বিভিন্ন অবস্থার জ্ঞান রাখার কথাকে স্পষ্ট করে দিয়েছেন। আর তিনি জানেন কে হিদায়াতের যোগ্য, আর কে তার অযোগ্য।(সূরাহ নুর,আয়াত নংঃ৩৫)

রাসুল মুহাম্মদ  (সা.) যে ধরনের জয়তুন পছন্দ করতেন, সেগুলো আমাদের দেশের জলপাইয়ের মতো নয়। সেগুলো আরেকটু ছোট ছোট হয়। একসঙ্গে অনেক খে’য়ে ফেলা যায়। তবে পরিবেশগত কারণে আমাদের দেশের জলপাই আরবের জলপাইয়ের সঙ্গে হু’বহু না মিললেও ঔষধি গুণে কিছুটা মিল পাওয়া যায়।

পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ যে জয়তুনের প্রশংসা করেছেন, তা জন্ম নেয় সিনাই পাহাড়ে। ইরশাদ হয়েছে,

 ‘وَ شَجَرَۃً  تَخۡرُجُ مِنۡ طُوۡرِ سَیۡنَآءَ تَنۡۢبُتُ بِالدُّہۡنِ وَ صِبۡغٍ  لِّلۡاٰکِلِیۡنَ ﴿۲۰﴾

এবং সৃষ্টি করি এক গাছ যা জন্মে সিনাই পর্বতে, এতে উৎপন্ন হয় ভোজনকারীদের জন্য তেল ও তরকারী। [১] [১] সে গাছ হল যায়তুনের গাছ। যার ফল পিষে তেল বের করা হয় এবং তা খাওয়ানো ও জ্বালানো হয়। যায়তুন ফলও তরকারী বা আচার রূপে ব্যাবহার করা হয়। তরকারিকেصبغ (রং) বলা হয়েছে। যেহেতু রুটিকে তার তরকারিতে ডুবিয়ে রাঙ্গানো হয় তাই। সিনাই পর্বত ও তার আশেপাশের এলাকা বিশেষ করে উক্ত গাছের জন্য বড় উৎকৃষ্ট ভুমি।।’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ২০)

তাফসিরবিদরা এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, এখানে আরবের জয়তুনের কথা বলা হয়েছে। (তাফসিরে তবরি) মহান আল্লাহ বরকতময় এই গাছটির কথা শুধু কোরআনেই নয়, বরং পূর্ববর্তী কিতাবেও উল্লেখ করেছেন। যার ফলে ইহুদিরা এই গাছের পাতা শান্তির প্রতীক হিসেবে দেখে।

রাসুল (সা.)-এর একটি হাদিস থেকেও জানা যায় যে আগের নবীরাও এই বরকতময় গাছের ফল ও তেল ব্যবহার করতেন। মিসওয়াক হিসেবে ব্যবহার করতেন এই গাছের ডালকে। (আল মুজামুল আওসাত)। বরকতময় এই ফল ও এর তেলের রয়েছে বহু স্বাস্থ্যগত উপকারিতা। গবেষ’কদের মতে, জয়তুন র’ক্তের অ’তিরি’ক্ত কোলে’স্টো’রল দূ’র করে, র’ক্তচা’প নিয়ন্ত্র’ণ করে। এতে রয়েছে প্রচুর আঁশ বা ফাইবার। ফলে এটি সবজি ও ফল দুইটিরই কাজ করে। আরো আছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন- ই।

এছাড়া অ্যান্টি অ’ক্সিডে’ন্ট হিসেবে কো’ষের সুর’ক্ষা’র কাজ করে জয়তুন। আলঝেই’মা’র বা স্মৃ’তিভ্র’ম, জ’টিল ধ’রনের টিউমা’র, র’গ কিছুটা ফু’লে যাওয়া, দাঁতের ক্যা’ভি’টি ইত্যাদি রো’গের প্রভা’ব কমি’য়ে আনে জলপাই। এ জন্যই হয়তো রাসুল (সা.) এই গাছের ডালকে উত্তম মিসওয়াক বলেছিলেন।

জয়তুন ক্যা’ন্সার বি’স্তারের বিরু’দ্ধে কো’ষের মে’মব্রে’নকে র’ক্ষা করে। র’ক্তশূ’ন্যতা বা অ্যানি’মিয়ার একটি বড় প্রতি’কারের নাম জলপাই। যৌ’ন উ’দ্দীপ’না বৃ’দ্ধি ও প্র’জন’ন প্রক্রি’য়ায় কার্য’কর ভূমি’কা রাখে ছোট্ট এই ফল।

এতে আছে প্রচুর পুষ্টিকর ও খনিজ উপাদান। যেমন—সোডিয়াম, পটাসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস ও আয়োডিন। শরীরে দরকারি ভিটামিন ও অ্যামাইনো এসি’ড সরব’রাহ করে। জলপাইতে আছে অলেইক এসি’ড, আর এই অলেইক এসি’ড হা’র্টের সুর’ক্ষা’র কাজ করে।চুল ও দাড়িতে নিয়মিত জলপাইয়ের তেল ব্যবহার করলে চুল পাকার প্রব’ণতা কমে যায়।

Post a Comment

0 Comments