আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى َيَتَقَارَبَ الْأَسْوَاقُ ‘‘ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত হবেনা যতক্ষণ না ঘন ঘন বাজার হবে’’।[1] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর এই বাণী সত্যে পরিণত হয়েছে’’। পৃথিবীর সকল স্থানে একই সময়ে ঘন ঘন বাজার হবে- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর বাণী তা প্রমাণ করেনা; বরং কোন দেশে কোন এক সময় তা হলেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর বাণী বাস্তবায়িত হয়েছে বলে মনে করতে হবে। আজকের প্রেক্ষাপটে আমরা যদি বাংলাদেশের জেলাসমূহের দিকে দৃষ্টি দেই তাহলে দেখতে পাবো যে সকল অঞ্চলেই ঘন ঘন বাজার তৈরী হয়েছে। এমন কোন রাস্তার মোড় পাওয়া যাবেনা যেখানে বাজার নেই।
কেউ কেউ বলেছেন ঘন ঘন বাজার হবে- একথার অর্থ হলো বর্তমানে আকাশ, স্থল ও জলপথে যাতায়াতের অত্যাধুনিক যানবাহন তৈরী হওয়াতে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত সহজ হয়ে গেছে। তাই বাজার দূরে দূরে হলেও অল্প সময়ে এক বাজার থেকে অন্য বাজারে যাওয়া যায় বিধায় বাজারগুলো খুব কাছাকাছি মনে হয়।
উত্তরে আমরা বলবোঃ হাদীছে বর্ণিত আসল অর্থ গ্রহণ করাই উত্তম। কারণ আমরা বিশ্বাস করি যে সমস্ত এলাকায় এখনও ঘন ঘন বাজার হয়নি সেখানেও কিয়ামত হওয়ার পূর্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর বাণী সত্যে পরিণত হবে। কাজেই তাদের ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়।
ফুটনোটঃ[1] — মুসনাদে আহমাদ, মাজমাউয্ যাওয়ায়েদ (৭/৩২৭)।
২৩) আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা হবে
আত্মীয়-স্বজনদের সাথে ভাল ব্যবহার করার উপর ইসলাম ধর্ম বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছে। যারা এ সম্পর্ক নষ্ট করবে তারা জান্নাতে প্রবেশ থেকে বঞ্চিত হবে। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
)فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ أُوْلَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمْ اللَّهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى أَبْصَارَهُمْ(
‘‘ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে সম্ভবতঃ তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমাদের আতমীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। আল্লাহ এদেরকেই করেন অভিশপ্ত আর করেন বধির ও দৃষ্টিশক্তিহীন’’। (সূরা মুহাম্মাদঃ ২২-২৩) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আত্মীয়তার সম্পর্ক ঠিক রাখতে উৎসাহ দিয়েছেন এবং তা ছিন্ন করা থেকে সাবধান করেছেন। তিনি বলেনঃ আল্লাহ তাআলা মাখলূকাত সৃষ্টি শেষ করলে রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তার বন্ধন উঠে দাঁড়ালো এবং আল্লাহর দরবারে আরজ করে বললোঃ হে আল্লাহ! আপনার কাছে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা হতে আশ্রয় চাই। আল্লাহ বললেনঃ ঠিক আছে; যে ব্যক্তি তোমার সাথে সম্পর্ক মিলিত রাখবে আমিও তার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবো। আর যে ব্যক্তি তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে আমিও তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবো। এতে কি তুমি সন্তুষ্ট নও? জবাবে আত্মীয়তার বন্ধন বললঃ হ্যাঁ, আমি সন্তুষ্ট আছি’’।[1] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেনঃ
لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَاطِعُ رَحِمٍ
‘‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবেনা’’।[2] তিনি আরো বলেনঃ
مَنْ سَرَّهُ أَنْ يُبْسَطَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ أَوْ يُنْسَأَ فِي أَثَرِهِ فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ
‘‘যে ব্যক্তি চায় তার রিজিক বৃদ্ধি হোক এবং বয়স বৃদ্ধি হোক সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে’’।[3]
আখেরী যামানায় কিয়ামতের পূর্বে ইসলামের এই সুন্দর নিদর্শনটির প্রতি অবহেলা করা হবে। লোকেরা কারণে অকারণে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
وَلَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يَظْهَرَ الْفُحْشُ وَقَطِيعَةُ الرَّحِمِ
‘‘অশ্লীল কর্ম বিস্তার এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট না করা পর্যন্ত কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবেনা’’।[4]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর বাণী সত্যে পরিণত হয়েছে। এমন কোন ইসলামী সমাজ পাওয়া যাবেনা যেখানে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা হচ্ছেনা। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চলে যায়, অথচ লোকেরা তাদের আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর রাখেনা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় একই গ্রাম কিংবা শহরে বসবাস করা সত্ত্বেও একে অপরের বাড়ীতে যাতায়াত করেনা। বিশেষ করে ধনীরা তাদের অসহায় আত্মীয়দের পরিচয় পর্যন্ত ভুলে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে চিনেও না চেনার ভান করে থাকে। (আল্লাহুল মুস্তাআন)
ফুটনোটঃ[1] — মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল বির্রি ওয়াস্ সিলাহ।
[2] — মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল আদাব।
[3] — বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল আদাব।
[4] — মুসনাদে আহমাদ। আহমাদ শাকের সহীহ বলেছেন।
২৪) লোকেরা কালো রং দিয়ে চুল-দাড়ি রাঙ্গাবে
সাদা চুল-দাড়ি মেহদী বা অন্য রং দিয়ে পরিবর্তন করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর সুন্নাত। তিনি সাদা চুলকে কালো রং বাদ দিয়ে অন্য রং দিয়ে পরিবর্তন করতে আদেশ দিয়েছেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
(إِنَّ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى لَا يَصْبُغُونَ فَخَالِفُوهُمْ)
‘‘ইয়াহুদী ও নাসারারা চুল ও দাড়িতে খেযাব লাগায় না। সুতরাং তোমরা খেযাব লাগিয়ে তাদের বিপরীত কর’’।[1]
কিন্তু কিয়ামতের পূর্বে লোকেরা এ আদেশ অমান্য করে কালো রং দিয়ে খেজাব (কলপ) লাগাবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
يَكُونُ قَوْمٌ يَخْضِبُونَ فِي آخِرِ الزَّمَانِ بِالسَّوَادِ كَحَوَاصِلِ الْحَمَامِ لَا يَرِيحُونَ رَائِحَةَ الْجَنَّةِ
‘‘আখেরী যামানায় একদল লোকের আগমণ হবে যারা সাদা চুল-দাড়ি কালো রং দিয়ে পরিবর্তন করবে। তারা জান্নাতের গন্ধও পাবেনা’’।[2]
হাদীছের ভাষ্য বাস্তবে পরিণত হয়েছে। পুরুষদের মাঝে দাড়ি ও মাথার চুল কালো রং দিয়ে পরিবর্তন করার প্রবণতা ব্যাপকভাবে দেখা দিয়েছে।
ফুটনোটঃ[1] — বুখারী, অধ্যায়ঃ আহাদীছুল আম্বীয়া।
[2] — আবূ দাঊদ, অধ্যায়ঃ কিতাবুত্ তারাজ্জুল, আলবানী (রঃ) হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন, গায়াতুল মুরাম, পৃষ্ঠা নং- ৮৪।
২৫) কৃপণতা বৃদ্ধি পাবে
কৃপণতা একটি নিকৃষ্ট অভ্যাস। আল্লাহ যাকে এই বদ অভ্যাস থেকে হেফাযত করবেন সে অবশ্যই সফলকাম হবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُوْلَئِكَ هُمْ الْمُفْلِحُونَ
‘‘যারা কার্পণ্য হতে নিজেদেরকে মুক্ত করেছে তারাই সফলকাম’’। (সূরা হাশরঃ ৯) ইসলাম সম্পদশীল লোকদেরকে আল্লাহর পথে ও ভাল কাজে সম্পদ খরচ করতে আদেশ করেছে এবং কৃপণতা করতে নিষেধ করেছে। কিন্তু কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে এই উম্মাতের ধনী লোকেরা দরিদ্র, অভাবী এবং ইয়াতীমদের জন্য খরচ করা থেকে বিরত থাকবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘‘কৃপণতা বৃদ্ধি পাওয়া কিয়ামতের অন্যতম আলামত’’।[1]
অনেক পূর্বেই এই আলামতটি দেখা দিয়েছে। বর্তমানেও মুসলিম সমাজে এক শ্রেণীর লোক প্রচুর সম্পদের অধিকারী। অভাবী ও দরিদ্র লোকেরা অনাহারে-অর্ধাহারে তাদের চোখের সামনেই দিনাতিপাত করছে। অথচ খুব অল্প সংখ্যক সম্পদশালী লোকই এদিকে ভ্রুক্ষেপ করে থাকে।
ফুটনোটঃ[1] — ফাতহুলবারী, (১৩/১৫)
২৬) ব্যবসা-বাণিজ্য ছড়িয়ে পড়বে
কিয়ামতের অন্যতম আলামত হচ্ছে মানুষের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য ছড়িয়ে পড়বে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
بَيْنَ يَدَيِ السَّاعَةِ تَسْلِيمُ الْخَاصَّةِ وَتَفْشُو التِّجَارَةُ حَتَّى تُعِينَ الْمَرْأَةُ زَوْجَهَا عَلَى التِّجَارَةِ
‘‘কিয়ামতের পূর্বে কেবল পরিচিত লোকদেরকেই সালাম দেয়া হবে।
ব্যবসা-বাণিজ্য ছড়িয়ে পড়বে। এমনকি স্ত্রীলোকেরা তাদের স্বামীদেরকে ব্যবসায়িক কাজে সহযোগিতা করবে’’।[1]
বর্তমানকালে এই আলামতটি প্রকাশিত হয়েছে। শহরে, গ্রামে-গঞ্জে এবং রাস্তার দ্বারে দ্বারে ব্যাপকভাবে দোকাপাট বৃদ্ধি পেয়েছে। মহিলারাও এতে পিছিয়ে নেই। তারাও স্বামীদের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশ নিচ্ছে। ধন-সম্পদ উপার্জন ও সঞ্চয়ে একে অপরের সাথে প্রতিযোগীতায় লিপ্ত রয়েছে।
ফুটনোটঃ [1] — মুসনাদে আহমাদ, আহমাদ শাকের (রঃ) হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন।
২৭) ভূমিকম্প বৃদ্ধি পাবে
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
لَا تَقُوْم السَّاعَةُ حَتَّى َتَكْثُرَ الزَّلَازِلُ
‘‘বেশী বেশী ভূমিকম্প না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবেনা’’।[1] ইবনে হাজার আসকালানী (রঃ) বলেনঃ উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের অনেক দেশেই বহু ভূমিকম্পের আবির্ভাব হয়েছে। বর্তমানে আমরা প্রায়ই পত্র-পত্রিকা ও প্রচার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে ভূমিকম্পের খবর শুনতে পাই। হতে পারে এগুলোই কিয়ামতের আলামত হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। যদি তা না হয়ে থাকে তাহলে আমরা বলবোঃ এসব ভূমিকম্প কিয়ামতের আলামত হিসেবে প্রকাশিতব্য ভূমিকম্পের প্রাথমিক পর্যায় স্বরূপ। ২০০৫ ইং সালে শ্রীলংকা, ইন্দোনেশীয়া, থাইল্যান্ড ও ভারতসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশীয়ার কয়েকটি দেশে হয়ে যাওয়া সুনামীর ঘটনা কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার একটি সুস্পষ্ট আলামত।
ফুটনোটঃ[1] — বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।
২৮) ভূমিধস ও চেহারা বিকৃতির শাস্তি দেখা দিবে
আখেরী যামানায় যখন অশ্লীলতা ও পাপাচার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে তখন এই উম্মাতের কিছু লোককে বিভিন্ন প্রকার শাস্তিতে পাকড়াও করা হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
يَكُوْنُ فِىْ آخِرِ هذِهِ الأُمَّةِ خَسْفٌ و مَسْخٌ وَقَذْفٌ قَالَتْ: قُلْتُ: يَا رَسُوْلَ اللَّه! أَ نُهْلَكُ وَ فِيْنَا الصَّالِحُوْنَ؟ قَالَ: نَعْمُ, إِذا ظَهَرَ الْخَبَثُ
‘‘আখেরী যামানায় এই উম্মাতের কিছু লোককে ভূমিধস, চেহারা পরিবর্তন এবং উপরে উঠিয়ে নিক্ষেপ করে শাস্তি দেয়া হবে। আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মাঝে সৎ লোক থাকতেও কি আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো? উত্তরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ হ্যাঁ, যখন অশ্লীলতা বৃদ্ধি পাবে’’।[1] তিনি আরো বলেনঃ
بَيْنَ يَدَيِ السَّاعَةِ مَسْخٌ وَخَسْفٌ وَقَذْفٌ
‘‘কিয়ামতের পূর্বে ভূমিধস, চেহারা পরিবর্তন এবং উপরে উঠিয়ে নিক্ষেপ করার মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হবে’’।[2]
আমাদের যামানায় এবং আমাদের পূর্ববর্তী যামানায় পূর্ব ও পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে অনেক ভূমিধসের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এটি কঠিন আযাবের পূর্ব সংকেত এবং আল্লাহর পক্ষ হতে তাঁর বান্দাদের জন্যে ভীতি প্রদর্শন এবং গুনাহগার ও বিদআতীদের জন্য শাস্তি স্বরূপ। যাতে লোকেরা শিক্ষা গ্রহণ করে ও তাদের প্রভুর দিকে প্রত্যাবর্তন করে এবং এটাও বিশ্বাস করে যে, কিয়ামত অতি নিকটবর্তী।
গান-বাজনাতে মত্ত এবং মদ পানকারীদেরকে উপরোক্ত শাস্তি প্রদান করা হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
فِي هَذِهِ الْأُمَّةِ خَسْفٌ وَمَسْخٌ وَقَذْفٌ فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ الْمُسْلِمِينَ يَا رَسُولَ اللَّهِ وَمَتَى ذَاكَ قَالَ إِذَا ظَهَرَتِ الْقَيْنَاتُ وَالْمَعَازِفُ وَشُرِبَتِ الْخُمُورُ
‘‘এই উম্মাতের মধ্যে ভূমিধস, চেহারা বিকৃতি এবং উপর থেকে নিক্ষেপ করে ধ্বংস করার শাস্তি আসবে। জনৈক সাহাবী জিজ্ঞেস করলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! কখন এরূপ হবে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ যখন ব্যাপক হারে গায়িকা, বাদ্যযন্ত্র এবং মদ্যপানের প্রসার ঘটবে’’।[3]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেনঃ ‘‘আমার উম্মতের একদল লোক মদ্যপানে লিপ্ত হবে। তবে মদের নাম পরিবর্তন করে অন্য নামে নামকরণ করবে। তারা বাদ্যযন্ত্র, বাঁশি বাজানো ও গান-বাজনা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। তাদের কতককে মাটির নীচে দাবিয়ে দেয়া হবে এবং অন্য এক দলকে শুকর ও বানরে পরিণত করা হবে’’।
পাপ কাজ ও নাফরমানীতে লিপ্ত হওয়ার কারণে আল্লাহ তাআলা বনী ইসরাঈলের এক শ্রেণীর লোকের চেহারা পরিবর্তন করে শুকর ও বানরে পরিবর্তন করে ধ্বংস করেছিলেন। তবে এই উম্মাতের মাঝে এখনও চেহারা পরিবর্তনের শাস্তি আসেনি। কিয়ামতের পূর্বে মানুষ যখন জেনা-ব্যভিচার, মদ্যপান এবং গান-বাজনাসহ নানা ধরণের পাপের কাজে লিপ্ত হবে তখন এই শাস্তি অবশ্যই আসবে। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সহীহ হাদীছে এ ব্যাপারে ভবিষ্যৎবাণী করেছেন। তা কিয়ামতের পূর্বে অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে।
ফুটনোটঃ[1] — তিরমিযী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান, ইমাম আলবানী সহীহ বলেছেন, সহীহুল জামে আস্ সাগীর, হাদীছ নং- ৮০১২ ।
[2] — ইবনে মাজাহ, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান, সহীহুল জামে আস্ সাগীর, হাদীছ নং- ২৮৫৩।
[3] — তিরমিযী, অধ্যায়ঃ আবওয়াবুল ফিতান। সহীহুল জামে আস্ সাগীর, হাদীছ নং- ৪১১৯।
২৯) পরিচিত লোকদেরকেই সালাম দেয়া হবে
কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার অন্যতম আলামত হচ্ছে মুসলমানেরা কেবল পরিচিত লোকদেরকেই সালাম দিবে।[1] এ বিষয়টি বর্তমান যামানায় সুস্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে। অনেক লোকই পরিচিত ব্যতীত অন্য কাউকে সালাম দেয়না। এটি সুন্নাত বিরোধী কাজ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরিচিত-অপরিচিত সকল মুসলিমকেই সালাম দিতে বলেছেন। কেননা সালাম বিনিময় করা মুসলমানদের ভিতরে ভালবাসা সৃষ্টির অন্যতম মাধ্যম। তিনি বলেনঃ ‘‘তোমরা ঈমানদার না হয়ে জান্নাতে যেতে পারবেনা। আর একে অপরকে ভাল না বাসলে ঈমানদার হতে পারবেনা। আমি কি তোমাদেরকে এমন বিষয়ের সন্ধান দেবনা যা করলে তোমরা একে অপরকে ভালবাসতে পারবে? তোমরা বেশী করে সালামের প্রচলন করো’’।[2]
ফুটনোটঃ[1] — মুসনাদে আহমাদ। আহমাদ শাকের সহীহ বলেছেন।
[2] — মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ঈমান।
৩০) বেপর্দা নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে
কিয়ামতের অন্যতম আলামত হচ্ছে মহিলারা ইসলামী পোষাক পরিত্যাগ করে এমন পোষাক পরিধান করবে যাতে তাদের সতর ঢাকবেনা। তারা মাথার চুল ও সৌন্দর্য্যের স্থানগুলো প্রকাশ করে ঘর থেকে বের হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘‘কিয়ামতের আলামত হচ্ছে মহিলাদের জন্য এমন পোষাক আবিস্কার হবে যা পরিধান করার পরও মহিলাদেরকে উলঙ্গ মনে হবে’’।[1] অর্থাৎ তাদের পোষাকগুলো এমন সংকীর্ণ ও আঁট-সাট হবে যে, তা পরিধান করলেও শরীরের গঠন ও সৌন্দর্যের স্থানগুলো বাহির থেকে সুস্পষ্ট বুঝা যাবে।
এই হাদীছটিতে নবুওয়াতের সুস্পষ্ট মু’জেযা রয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে যা বলেছেন তা আজ হুবহু বাস্তবায়িত হয়েছে।
ফুটনোটঃ[1] — ইমাম হায়ছামী বলেনঃ ইমাম বুখারী এই হাদীছের বর্ণনাকারীদের থেকে হাদীছ গ্রহণ করেছেন, মাজমাউজ্ জাওয়ায়েদ, (৭/৩২৭)।
কিয়ামতের আলামত কিয়ামতের ছোট আলামত আব্দুল্লাহ্ শাহেদ আল-মাদানী
৩১) মুমিনের স্বপ্ন সত্য হবে
কিয়ামতের অন্যতম আলামত হচ্ছে আখেরী যামানায় মুমিন ব্যক্তির স্বপ্ন মিথ্যা হবেনা; বরং ঘুমন্ত অবস্থায় সে যা স্বপ্নে দেখবে তা সত্যে পরিণত হবে। যার ঈমান যত মজবুত হবে তার স্বপণও তত বেশী সত্য হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
إِذَا اقْتَرَبَ الزَّمَانُ لَمْ تَكَدْ رُؤْيَا الْمُسْلِمِ تَكْذِبُ وَأَصْدَقُكُمْ رُؤْيَا أَصْدَقُكُمْ حَدِيثًا وَرُؤْيَا الْمُسْلِمِ جُزْءٌ مِنْ خَمْسٍ وَأَرْبَعِينَ جُزْءًا مِنَ النُّبُوَّةِ وَالرُّؤْيَا ثَلَاثَةٌ فَرُؤْيَا الصَّالِحَةِ بُشْرَى مِنَ اللَّهِ وَرُؤْيَا تَحْزِينٌ مِنَ الشَّيْطَانِ وَرُؤْيَا مِمَّا يُحَدِّثُ الْمَرْءُ نَفْسَهُ فَإِنْ رَأَى أَحَدُكُمْ مَا يَكْرَهُ فَلْيَقُمْ فَلْيُصَلِّ وَلَا يُحَدِّثْ بِهَا النَّاسَ
‘‘যখন কিয়ামত নিকটবর্তী হবে তখন মু’মিন ব্যক্তির স্বপ্ন মিথ্যা হবেনা। যে মু’মিন মানুষের সাথে কথা-বার্তায় সত্যবাদী হবে তাঁর স্বপ্ন বেশী সত্যে পরিণত হবে। মু’মিনের স্বপ্ন নবুওয়াতের পয়তাল্লিশ ভাগের একভাগের সমান। স্বপ্ন তিন প্রকার। (১) মু’মিনের সত্য স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ হতে সুসংবাদ স্বরূপ। (২) যে সমস্ত স্বপ্ন মনের ভিতর দুশ্চিন্তা আনয়ন করে তা শয়তানের পক্ষ থেকে। (৩) আর এক প্রকারের স্বপ্ন অন্তরের কল্পনা মাত্র। সুতরাং তোমাদের কেউ যদি স্বপ্নে অপছন্দনীয় কিছু দেখে সে যেন বিছানা থেকে উঠে নামাযে দাঁড়িয়ে যায় এবং স্বপ্নের কথা কারো কাছে প্রকাশ না করে’’।[1]
ইবনে আবি হামজাহ বলেনঃ ‘‘আখেরী যামানায় মু’মিনের স্বপ্ন সত্য হওয়ার অর্থ এই যে, অধিকাংশ সময় স্বপ্নে যা দেখেছে তাই বাস্তবে পরিণত হবে। স্বপ্নের ব্যাখ্যার প্রয়োজন হবেনা। অথচ ইতিপূর্বে তা অস্পষ্ট হওয়ার কারণে ব্যাখ্যার প্রয়োজন হতো। ফলে কখনও ব্যাখ্যার বিপরীত হতো’’।
শেষ যামানায় স্বপ্ন সত্যে পরিণত হওয়ার কারণ এই যে তখন মুমিন লোকের সংখ্যা কমে যাবে। ফলে সে সময় মুমিন ব্যক্তি কোন সহযোগী
ও শান্তনা দানকারী খুঁজে পাবেনা। তাই সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে তাকে শান্তনা দেয়া হবে।[2]
কোন্ যামানায় মুমিনের স্বপ্ন সত্যে পরিণত হবে তার ব্যাপারে আলেমদের কয়েক ধরণের বক্তব্য রয়েছেঃ
ক) এটি হবে কিয়ামতের পূর্বে যখন ইল্মে দ্বীন উঠিয়ে নেয়া হবে, ইসলামী শরীয়তের নাম-নিশানা মিটে যাবে এবং ফিতনা-ফাসাদ ও যুদ্ধ-বিগ্রহ সংঘটিত হবে।
খ) আখেরী যামানায় যখন মুমিনের সংখ্যা কমে যাবে এবং কুফর, পাপাচারিতা ও মূর্খতা ছড়িয়ে পড়বে তখন মুমিনের স্বপ্ন সত্যে পরিণত হবে। মুমিন লোকের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে এক সময় তারা একাকীত্ব অনুভব করবে এবং নিজেদেরকে অসহায় মনে করবে। অন্য একজন মুমিনের সাথে বসে কথা বলার এবং মনের ভাব বিনিময় করার মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। এহেন কঠিন পরিস্থিতে স্বপ্নের মাধ্যমে মু’নিদেরকে শান্তনা প্রদান করা হবে।
গ) এটি হবে আখেরী যামানায় ঈসা (আঃ) আকাশ থেকে নেমে আসার পর। কারণ খোলাফায়ে রাশেদার যুগের পর ঈসা (আঃ)এর যামানা হবে সর্বোত্তম যামানা। সে যুগের মানুষ অত্যন্ত সত্যবাদী হবে। কাজেই তাদের স্বপ্নও সত্য হবে। (আল্লাহই ভাল জানেন)
ফুটনোটঃ[1] — মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুত তা’বীর।
[2] — ফাতহুলবারী, (১২/৪০৬)
৩২) সুন্নাতী আমল সম্পর্কে গাফিলতী করবে
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘‘তোমাদের কেউ যখন মসজিদে প্রবেশ করবে সে যেন বসার পূর্বে দুই রাকাত নামায পড়ে নেয়’’।[1] কিছু সংখ্যক লোক ব্যতীত কিয়ামতের পূর্ব মুহূর্তে মুসলমানেরা এই গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাতটির উপর আমল ছেড়ে দিবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘‘কিয়ামতের আলামত হচ্ছে লোকেরা মসজিদের ভিতরে প্রবেশ করবে কিন্তু তাতে দু’রাকাত নামায পড়বেনা’’।[2]
ফুটনোটঃ[1] — মুসলিম, অধ্যায়ঃ মুসাফিরের নামায।
[2] — সহীহ ইবনে খুজায়মা। ইমাম আলবানী হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন। সিলসিলায়ে সাহীহা হাদীছ নং- ৬৪৯।
৩৩) নতুন মাসের চাঁদ উঠার সময় বড় হয়ে উদিত হবে
মাসের প্রথম দিন আমরা চাঁদকে একেবারে চিকন ও সরু অবস্থায় উঠতে দেখি। কিন্তু কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে চাঁদ প্রথম দিনেই অনেক বড় হয়ে উদিত হবে। দেখে মনে হবে এটি দুই দিন বা তিন দিনের চাঁদ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘‘কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার আলামত হচ্ছে, চন্দ্র মোটা হয়ে উদিত হবে। বলা হবে এটি দুই দিনের চাঁদ’’।[1]
ফুটনোটঃ[1]- তাবরানী। ইমাম আলবানী হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন, সহীহুল জামে আস্ সাগীর, হাদীছ নং- ৫৭৭৪।
৩৪) মিথ্যা কথা বলার প্রচলন বৃদ্ধি পাবে
কিয়ামতের পূর্বে ব্যাপকভাবে মিথ্যা কথা বলার প্রচলন ঘটবে। এমনকি এক শ্রেণীর লোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর নামে মিথ্যা হাদীছ রচনা করে মানুষের মাঝে প্রচার করবে। বাস্তবে তাই হয়েছে। ইসলাম প্রচার ও তাবলীগের নামে বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনী ও জাল হাদীছ তৈরী করে এক শ্রেণীর লোক মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘‘আখেরী যামানায় আমার উম্মাতের কিছু লোক তোমাদের কাছে এমন কথা বর্ণনা করবে, যা তোমরাও শুননি এবং তোমাদের বাপ-দাদারাও শুনেনি। তোমরা তাদের থেকে সাবধান থাকবে। তারা যেন তোমাদেরকে বিভ্রান্ত করতে না পারে’’।[1]
হাদীছের ভাষ্য সত্যে পরিণত হয়েছে। বর্তমানকালে মানুষের মাঝে মিথ্যা কথা বলার অভ্যাস ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যদি বলা হয় বর্তমানে একজন সত্যবাদী খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন তাতেও অতিরঞ্জিত হবেনা বলে মনে হয়। যাচাই-বাছাই না করেই মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্যে মিথ্যা সংবাদ প্রচার করতে লোকেরা মোটেও দ্বিধাবোধ করেনা। প্রচার মাধ্যমগুলো অনবরত মিথ্যা সংবাদ প্রচার করার কারণে সত্য-মিথ্যার মাঝে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে যায়।
ফুটনোটঃ[1] — মুসলিম, মুকাদ্দিমা।
৩৫) মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার প্রচলন ঘটবে
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
إِنَّ بَيْنَ يَدَيِ السَّاعَةِ شَهَادَةَ الزُّورِ وَكِتْمَانَ شَهَادَةِ الْحَقِِّ
‘‘কিয়ামতের পূর্বে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার প্রচলন ঘটবে এবং সত্য সাক্ষ্য গোপন করা হবে’’।[1] বর্তমান সমাজে সামান্য স্বার্থের বিনিময়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার প্রচলন ব্যাপকভাবে দেখা দিয়েছে। অপর পক্ষে সত্যের সাক্ষী দেয়ার লোক খুব কমই পাওয়া যায়।
ফুটনোটঃ[1] — মুসনাদে আহমাদ। আহমাদ শাকের সহীহ বলেছেন।
৩৬) মহিলার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং পুরুষের সংখ্যা কমে যাবে
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
مِنْ أَشْرَاطِ السَّاعَةِ أَنْ َتَكْثُرَ النِّسَاءُ وَيَقِلَّ الرِّجَالُ حَتَّى يَكُونَ لِخَمْسِينَ امْرَأَةً الْقَيِّمُ الْوَاحِد
‘‘কিয়ামতের আলামত হচ্ছে, মহিলার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং পুরুষের সংখ্যা কমে যাবে। এমনকি পঞ্চাশ জন মহিলার দেখা-শুনার জন্য মাত্র একজন পুরুষ থাকবে’’।[1]
এই হাদীছের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, কিয়ামতের পূর্বে ফিতনার সময় ব্যাপক যুদ্ধ হবে। যুদ্ধে যেহেতু কেবল পুরুষেরাই অংশগ্রহণ করে থাকে তাই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে পুরুষেরা অকাতরে নিহত হবে। ফলে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রঃ) এই মতটিকে প্রত্যাখ্যান করে বলেনঃ হাদীছের প্রকাশ্য অর্থ হলো কোন কারণ ছাড়াই শুধু কিয়ামতের আলামত হিসেবে নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। আল্লাহ তাআলা আখেরী যামানায় পুরুষের তুলনায় বেশী নারী সৃষ্টি করবেন। বর্তমানেও এ আলামতটি প্রকাশিত হয়েছে। কোন কোন দেশে জরিপ করে দেখা গেছে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা অনেক বেশী। ভবিষ্যতে আরো বৃদ্ধি পাবে। মোটকথা স্বভাবগত ও যুদ্ধ উভয় কারণে পুরুষের সংখ্যা কমতে পারে।
ফুটনোটঃ[1] — বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ইলম।
৩৭) হঠাৎ মৃত্যুর বরণকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘‘কিয়ামতের অন্যতম আলামত হচ্ছে হঠাৎ করে মৃত্যুবরণকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে’’।[1]
বর্তমানে এরকম ঘটনা প্রায়ই শুনা যায়। দেখা যায় একজন মানুষ সম্পূর্ণ সুস্থ। হঠাৎ শুনা যায় সে মৃত্যু বরণ করেছে। সুতরাং মানুষের উচিৎ মৃত্যু আসার পূর্বেই আল্লাহর কাছে তাওবা করা এবং সকল প্রকার পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা।
ফুটনোটঃ[1] — মাজমাউয্ যাওয়ায়েদ (৭/৩২৫) সহীহুল জামে আস্ সাগীর, হাদীছ নং- ৫৭৭৫)।
৩৮) আরব উপদ্বীপ নদ-নদী এবং গাছপালায় পূর্ণ হয়ে যাবে
বর্তমানে আরব উপদ্বীপে কোন নদী-নালা নেই। গাছপালার সংখ্যা খুবই কম। চাষাবাদের উপযোগী ভূমির পরিমাণ অতি নগণ্য। কিয়ামতের পূর্ব মুহূর্তে আরব উপদ্বীপের পরিবেশ পরিবর্তন হয়ে যাবে এবং তা গাছপালা ও নদী-নালায় পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى تَعُودَ أَرْضُ الْعَرَبِ مُرُوجًا وَأَنْهَارًا
‘‘ততদিন পর্যন্ত কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবেনা যে পর্যন্ত না আরব উপদ্বীপ গাছপালা ও নদী-নালায় পূর্ণ হবে’’।[1]
হাদীছের প্রকাশ্য বর্ণনা থেকে বুঝা যাচ্ছে যে আরব দেশসমূহে কিয়ামতের পূর্বে পানির অভাব হবেনা। তাতে প্রচুর পরিমাণ নদী প্রবাহিত হবে। ফলে গাছ-পালা ও নানা উদ্ভিদ উৎপন্ন হবে এবং বন-জঙ্গলে ভরে যাবে।
ফুটনোটঃ[1] — মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুয্ যাকাত।
৩৯) প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে, ফসল হবেনা
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يُمْطَرَ النَّاسُ مَطَرًا لَا تُكِنُّ مِنْهُ بُيُوتُ الْمَدَرِ وَلَا تُكِنُّ مِنْهُ إِلَّا بُيُوتُ الشَّعَرِ
‘‘ততদিন কিয়ামত হবেনা যতদিন না আকাশ থেকে প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে। এতে মাটির তৈরী ঘরগুলো ভেঙ্গে পড়বে এবং পশমের ঘরগুলো রক্ষা পাবে’’।[1] তিনি আরো বলেনঃ
لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يُمْطَرَ النَّاسُ مَطَرًا عَامًّا وَلَا تَنْبُتَ الْأَرْضُ شَيْئًا
‘‘ততদিন কিয়ামত হবেনা যেপর্যন্ত না ব্যাপক বৃষ্টিপাত হবে। কিন্তু যমিনে কোন ফসলই উৎপন্ন হবেনা’’।[2] স্বাভাবিক নিয়ম হলো বৃষ্টির মাধ্যমে যমিনে ফসল উৎপন্ন হবে। কিন্তু কিয়ামতের পূর্বে স্বাভাবিক অবস্থা পরিবর্তন হয়ে যাবে।
ফুটনোটঃ[1] — মুসনাদে আহমাদ, আহমাদ শাকের সহীহ বলেছেন।
[2] — মুসনাদে আহমাদ, ইমাম হায়ছামী মাজমাউয্ যাওয়াদে বর্ণনা করেছেন, (৭/৩৩০)। ইমাম ইবনে কাছীর বলেনঃ হাদীছের সনদ খুব ভাল। নেহায়া, (১/১৮০)
৪০) ফুরাত নদী থেকে স্বর্ণের পাহাড় বের হবে
কিয়ামতের অন্যতম আলামত হচ্ছে ফুরাত নদী থেকে একটি স্বর্ণের পাহাড় বের হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يَحْسِرَ الْفُرَاتُ عَنْ جَبَلٍ مِنْ ذَهَبٍ يَقْتَتِلُ النَّاسُ عَلَيْهِ فَيُقْتَلُ مِنْ كُلِّ مِائَةٍ تِسْعَةٌ وَتِسْعُونَ وَيَقُولُ كُلُّ رَجُلٍ مِنْهُمْ لَعَلِّي أَكُونُ أَنَا الَّذِي أَنْجُو
‘‘তত দিন পর্যন্ত কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবেনা যতদিন না ফুরাত নদী থেকে একটি স্বর্ণের পাহাড় বের হবে। মানুষেরা এটি দখল করার জন্যে যুদ্ধে লিপ্ত হবে। এ যুদ্ধে শতকরা নিরানববই জনই নিহত হবে। তাদের প্রত্যেকেই বলবেঃ আমিই এযুদ্ধে রেহাই পাবো এবং স্বর্ণের পাহাড়টি দখল করে নিবো’’।[1] তিনি আরো বলেনঃ
(يُوشِكُ الْفُرَاتُ يَحْسِرُ عَنْ كَنْزٍ مِنْ ذَهَبٍ فَمَنْ حَضَرَهُ فَلَا يَأْخُذْ مِنْهُ شَيْئًا)
‘‘অচিরেই ফুরাত নদী থেকে একটি স্বর্ণের গুপ্তধন বের হবে। সে সময় যে ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত হবে সে যেন তা থেকে কোন কিছুই গ্রহণ না করে’’।[2]
ফুটনোটঃ[1] — বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।
[2] — মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান ওয়া আশরাতুস-সাআ।
৪১) জড় পদার্থ এবং হিংস্র পশু মানুষের সাথে কথা বলবে
কিয়ামতের পূর্ব মুহূর্তে হিংস্র প্রাণী এবং জড় পদার্থ মানুষের সাথে কথা বলবে। আল্লাহ রাববুল আলামীন মানুষকে কথা বলার শক্তি দিয়েছেন। তিনি অন্যান্য সৃষ্টিজীবকেও কথা বলার ক্ষমতা দিতে মোটেই অক্ষম নন।
ইমাম আহমাদ (রঃ) আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন, ‘‘জনৈক রাখাল মাঠে ছাগল চরাচিছল। হঠাৎ একটি নেকড়ে বাঘ এসে একটি ছাগলের উপর আক্রমণ করলো। রাখাল বাঘের পিছনে ধাওয়া করে ছাগলটি ছিনিয়ে আনল। বাঘটি একটি টিলার উপর বসে বলতে লাগলোঃ তুমি কি আল্লাহকে ভয় করোনা? আল্লাহ আমাকে একটি রিজিক দিয়েছিলেন। আর তুমি তা ছিনিয়ে নিলে। রাখাল বললঃ কি আশ্চর্য্য ব্যাপার! মানুষের ন্যায় বাঘও আমার সাথে কথা বলছে। বাঘ বললোঃ আমি কি তোমাকে এর চেয়ে আশ্চর্য্যজনক খবর দিবোনা? মদ্বীনায় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অতীতে যা ঘটেছে এবং আগামীতে যা ঘটবে তা সম্পর্কে মানুষকে সংবাদ দিচ্ছে। রাখাল তার ছাগলের পাল নিয়ে মদ্বীনায় প্রবেশ করে ছাগলগুলো এক স্থানে রেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর কাছে এসে ঘটনা খুলে বলল। এতক্ষণে নামাযের সময় হয়ে গেল। নামায শেষে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাখালকে বললেনঃ ‘‘তুমি সবার সামনে ঘটনা খুলে বল’’। সে ঘটনা বর্ণনা শেষ করলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ রাখাল সত্য বলেছে। ঐ আল্লাহর শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ ততদিন পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবেনা যতক্ষণ না হিংস্র প্রাণী মানুষের সাথে কথা বলবে। মানুষ তার হাতের লাঠির সাথে কথা বলবে, পায়ের জুতার সাথে কথা বলবে। এমনকি ঘরের স্ত্রী তার স্বামীর অনুপস্থিতে কি করছে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তাকে বলে দিবে’’।[1]
ফুটনোটঃ[1] — মুসনাদে আহমাদ, ইমাম আলবানী সহীহ বলেছেন, সিলসিলায়ে সাহীহা হাদীছ নং- ১২২।
৪২) ফিতনায় পতিত হয়ে মানুষ মৃত্যু কামনা করবে
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
لَا تَقُوْمُ السَّاعَةُ حَتَّى يَمُرَّ الرَّجُلُ بِقَبْرِ الرَّجُلِ فَيَقُولُ يَا لَيْتَنِي مَكَانَه
‘‘ততদিন কিয়ামত হবেনা যতদিন না লোকেরা কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করবে এবং বলবেঃ হায় আফসোস! আমি যদি এ কবরের অধিবাসী হতাম’’।[1] তিনি আরো বলেনঃ ঐ আল্লাহর শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ ততদিন দুনিয়া ধ্বংস হবেনা যতদিন না একজন লোক কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে তার উপর গড়াগড়ি করবে এবং বলবেঃ হায় আফসোস! আমি যদি এ কবরবাসীর স্থানে হতাম। ফিতনা ও মুসীবত সহ্য করতে না পেরেই সে এরূপ কথা বলবে।[2]
যখন ফিতনা বিস্তার লাভ করবে পৃথিবীর অবস্থা পরিবর্তন হয়ে যাবে এবং ইসলামী শরীয়ত মিটে যাবে তখন এ ধরণের পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। যদিও এখনও এধরণের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি কিন্তু যেহেতু এমর্মে সহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তাই এটি অবশ্যই সংঘটিত হবে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেনঃ তোমাদের উপর এমন এক সময় আসবে তখন যদি কেউ মৃত্যু বিক্রি হচ্ছে বলে জানতে পারে তবে মৃত্যু ক্রয় করে নেয়ার চেষ্টা করবে।[3]
বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।
মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।ফাইযুল কাদীর, (৬/৪১৮)
৪৩) কাহতান গোত্র থেকে একজন সৎ লোক বের হবে
আখেরী যামানায় কাহতান গোত্র থেকে একজন সৎ লোক আগমণ করবে। মানুষ তাঁর নেতৃত্বে ঐক্য বদ্ধ হয়ে তাঁর আনুগত্য করবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يَخْرُجَ رَجُلٌ مِنْ قَحْطَانَ يَسُوقُ النَّاسَ بِعَصَاهُ
‘‘ততদিন কিয়ামত হবেনা যতদিন না কাহতান গোত্র থেকে একজন লোক বের হয়ে তার লাঠির মাধ্যমে লোকদেরকে পরিচালিত করবে’’।
লাঠির মাধ্যমে জনগণকে পরিচালিত করার অর্থ হলো আখেরী যামানায় তার রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। মানুষ তার আনুগত্য করবে। তিনি হবেন একজন সৎ লোক। হাদীছের ভাষ্য থেকে বুঝা যায় তিনি কঠোর হবেন। তবে সকলের বিরুদ্ধে কঠোরতা করবেন না। অপরাধীদের বিরুদ্ধেই কেবল তিনি কঠিন হবেন।
বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।أشراط الساعة, يوسف عبد الله الوابل ص ২১৯
0 Comments